বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী, মহান জাতীয় সংসদের সাবেক উপনেতা, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি, সংসদীয় আসন ১৪৪ তথা শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসনের সাবেক সাংসদ বেগম মতিয়া চৌধুরী মারা গেছেন।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ১২টা ৫৭ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এভারকেয়ার হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ ও মতিয়া চৌধুরীর মামা মোস্তফা জামাল হায়দার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এভারকেয়ার হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানান, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত মতিয়া চৌধুরীকে সকালে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এরপরই তারা ইসিজি করে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু সব ধরনের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মতিয়া চৌধুরী পরপারে পাড়ি জমান (বিভিন্ন সূত্র)।
মতিয়া চৌধুরী ১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক শেরপুরের নকলা উপজেলার কৃতিসন্তান বজলুর রহমান-এঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
তথ্যমতে, মতিয়া চৌধুরী ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিলো বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে। তিনি ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা শেষে সক্রিয়ভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন মতিয়া চৌধুরী। রাজনৈতিক দক্ষতার কারণেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদস্য নির্বাচিত হন।
‘বাংলার অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত বেগম মতিয়া চৌধুরী ১৯৭০ ও ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রচারণা, তদবির এবং যুদ্ধাহতদের সেবার কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাজীবন ভোগ করেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে মতিয়া চৌধুরী ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে নকলা-নালিতাবাড়ীর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলা নিয়ে গঠিত শেরপুর-২ আসন থেকে তিনি ১৯৯১ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জাহেদ আলী চৌধুরী-এঁর কাছে পরাজিত হন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে জাহেদ আলী চৌধুরীকে হারিয়ে তৃতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং সবশেষ ২০২৪-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মতিয়া চৌধুরী (যদিও এসব নির্বাচনের ভোটা-ভোটি নিয়ে দেশ-বিদেশে বিতর্ক রয়েছে)।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায় কৃষি ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি দেশের শিক্ষাখাতে বড় পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করেন। তার সময়েই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়, যা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বেগম মতিয়া চৌধুরী।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মতিয়া চৌধুরীর প্রবেশ ঘটলেও ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সভা সেমিনারে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নজর কাড়েন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, তিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এঁর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন বেগম মতিয়া চৌধুরী।
অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ। এক শোক বার্তায় মতিয়া চৌধুরীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি দলের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে।
এছাড়াও দৈনিক আমাদের দিন এর প্রধান সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান (শাশ্বত মনির) মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ‘অগ্নিকন্যা’ খ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যু বাংলাদেশর রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। গণতন্ত্র, রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নে তার অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আমি তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন, আমিন।