কোনোভাবেই বুঝার উপায় নেই এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়। নিচে বাস কাউন্টার আর উপরে বিল্ডিংয়ের তিনটি তলা ভাড়া নিয়ে ১০ বছর ধরে চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। এটি কক্সবাজারের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
আর ভাড়া নেয়া তিনটি তলার সেই ক্যাম্পাসের পরিবেশ দেখে যে-কেউ এটিকে ভুলবশতও বিশ্ববিদ্যালয় ভাববে না, বরং কোচিং সেন্টার বলাটাই অনেকটা সমীচীন! বাইরে বাস কাউন্টার হওয়াতে শ্রেণিকক্ষে কার্যক্রম পরিচালনাও বেশ অস্বস্তিকর।
নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ইউজিসি থেকে বেশ কয়েকবার তাগাদা দিলেও জমি কেনা নিয়ে কোনো সদিচ্ছাই নেই প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকবার জমি কেনার উদ্যোগ নিলেও টাকার অজুহাতে তা ভেস্তে যায়। সর্বশেষ রামুর চেইন্দাতে জমি বায়না করলেও তা বেশিদূর আগাতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমেদ চান জমিটি নিজের নামে ক্রয় করতে। তাই এনিয়ে তার গড়িমসির কারণেই মূলত এই দীর্ঘসূত্রতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা না থাকার অজুহাতে জমি ক্রয় না করা, শ্রেণী কক্ষে মান উন্নয়ন না করা, এমনকি শিক্ষকদের বেতন না দিলেও নানাভাবে আর্থিক অনিয়মই যেনো নিয়ম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। যার প্রমাণও পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসি।
ইউজিসির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি। প্রতিবেদনে বলা হয়- “বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এবং ইতোপূর্বে কমিশন প্রদত্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ অনুপস্থিতি পূর্বের ন্যায় এখনো বিদ্যমান এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয় উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি-এর বিশ্ববিদ্যালয় হতে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ আইন ও নৈতিকতার মানদণ্ডে দুষ্ট বলেও মন্তব্য করে ইউজিসির তদন্ত কমিটি।
ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান, সেক্রেটারিসহ কোন সদস্য যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন তহবিল থেকে কোনরূপ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়।
মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের অনুমোদন ব্যতিরেকে সংরক্ষিত তহবিল হতে অর্থ উত্তোলন করা অব্যাহত থাকায় উষ্মা প্রকাশ করে ওই তদন্ত কমিটি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের বেতন কাঠামোকে একেবারে অপ্রতুল এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, এতস্বল্প বেতনে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষা কোনটিই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বেতন কাঠামোতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন এবং কোনোক্রমেই যেন তা জাতীয় বেতন স্কেলের নিচে না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনাও প্রদান করা হয়।
কিন্তু সেই বেতন স্কেল এখনো ইউজিসির নির্দেশনা মতো প্রণয়ন করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক নিয়োগ- নীতিমালার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায়, ইউজিসির তদন্ত কমিটি মনে করে এটি শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার শামিল।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ভারপ্রাপ্ত এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নেই বলে প্রতিবেদনে জানায় ইউজিসির তদন্ত কমিটি।
কিন্তু সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদে থাকা শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর যোগ্যতা না থাকা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার করা হলেও তাকে এখনো পর্যন্ত স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চালু ছিলো ‘সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে একটি প্রকল্প। আর সেন্টারটি পরিচালনা করতেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সেক্রেটারী গিয়াস উদ্দিন।
এনিয়ে ইউজিসির তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে বলেন, “মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে ‘সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ পরিচালনা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অবিলম্বে সেন্টারটি বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সেক্রেটারী জনাব গিয়াস উদ্দিন উক্ত সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য যেসমস্ত বেতন- ভাতা গ্রহণ করেছেন তা অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে ফেরত প্রদানপূর্বক কমিশনকে অবহিত করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।”
কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো অর্থই গিয়াস উদ্দিন জমা দেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে।
দিয়ানাত ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে থাকে। তা নিয়েও আছে নানান অনিয়মের অভিযোগ। বৃত্তির অর্থও জমা হয়না বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে। যে অর্থ ঘুরে আসে চেয়ারম্যান হয়ে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুযোগ না দেয়ার বিষয়টিও উঠে আসে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড অনেকটাই নামকাওয়াস্তে। বোর্ডের সদস্যরা মাথা ঘামাননা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিষয়েই। বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় তারা ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি ও ব্যবসা নিয়ে। মঙ্গলবার (১১ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির সভা থাকলেও সেখানে উপস্থিতই হননি ট্রাস্টিজের কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম।
ট্রাস্টিজের কোষাধ্যক্ষ শাহ আলমের কাছে সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে, তার তেমন কোনো আগ্রহই প্রকাশ পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। সবকিছুই চেয়ারম্যান জানেন বলে মন্তব্য করে কোনো কিছুর সদুত্তর দিতে পারেননা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া ভুঁইয়া এ বিষয়ে কথা বলতে তার কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন।