একসময় যোগাযোগের বাহন ছিল চিঠিপত্র আদান-প্রদান আর এ কাজটি করত ডাক বিভাগ। জরুরি প্রয়োজনে, অফিস-আদালত, প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, সামাজিক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডাক বিভাগের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সময়ের পরবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের অতিপ্রাচীন এই মাধ্যমটি ক্রমেই হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। সহজলভ্য যোগাযোগ মাধ্যম থাকায় মানুষ আর পুরনো এবং সময় সাপেক্ষ মাধ্যম হিসেবে ডাক বিভাগের দ্বারস্থ হয়না। ডাকবাক্স, পোস্টমাস্টার আর ডাকপিয়নের সেই সোনালি অতীত আর আমাদের সমাজব্যবস্থায় নেই, যদিও এই ডাক বিভাগ আজো মন্থর গতিতে হলেও তার ঐতিহ্য ও প্রয়োজনীয়তাকে ধারণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। ডাক বিভাগেও সংযোজিত হয়েছে ডিজিটাল ব্যাবস্থা। তবে লিখিত চিঠিপত্র সেই পুরনো সিস্টেমেই চলছে। বর্তমানে ডাক বিভাগের আদলে কুরিয়ার সার্ভিস বেশ জনপ্রিয় এবং বিশ্বস্ত মাধ্যম। এই ব্যাবস্থায় স্বল্প সময়ে এবং যেকোন পণ্য বাহনের সুযোগ থাকায় মানুষের এটাতেই ঝোঁক বেশী।
প্রতি বছরের ন্যায় আবারও হাজির বিশ্ব ডাক দিবস। ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতি বছর ডাক দিবস পালিত হয় ৯ অক্টোবর। ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশের মধ্যে ডাক আদান-প্রদানকে অধিকতর সহজ ও সমৃদ্ধ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজনীন পারস্পরিক যোগাযোগকে সুসংহত করাই ইউরোপের ২২টি দেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৮৭৪ সালের ৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে গঠিত হয় ‘জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন’। পরে ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৬তম অধিবেশনে প্রতি বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে জার্মানির হামবুর্গে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৯তম অধিবেশনে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবসের নাম বদলে বিশ্ব ডাক দিবস করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ওই সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে অক্টোবরের ৯ তারিখ বিশ্ব ডাক দিবস পালন করে আসছে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এনালগ প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই কমছে, বাড়ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশেষ করে ইন্টারনেট নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অত্যধিক সহজলভ্য হওয়ায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তথাপি ডাক যোগাযোগের প্রয়োজনিয়তা খুব একটা কমেনি। বিশেষ করে ডকুমেন্টস এর হার্ডকপি কালেকশন, প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রির আদান প্রদান কার্যক্রম পরিচালনায়। কালের বিবর্তনে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভব হওয়ায় এখন দরকারি যোগাযোগ বা আপনজনের কোনো খবরের জন্য ডাক পিয়নের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না। প্রিয়জন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক না কেন মোবাইল, ইন্টারনেট, জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার, ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু, বাইবারসহ একাধিক উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে যেকোনো ধরনের যোগাযোগ খুবই সহজলভ্য এবং মানুষের হাতের নাগালে। একসময় ফ্যাক্সের মাধ্যমে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করা হলেও বর্তমানে ইমেইলের বহুবিধ ব্যবহারে ফ্যাক্সের ব্যবহার দিন দিন কমছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে আর্থিক লেনদেন আর দুঃসাধ্য নয়, খুবই সহজে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন তা হাতের মুঠোয় বলা যায়। ডাক ব্যবস্থার সময় মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হতো। তবে ডাক বিভাগের আদলে বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিস। ডাক যোগাযোগের অনেক কাজ যেমন, চিঠিপত্র, মালামাল পরিবহন এখন এই মাধ্যমে দেশে-বিদেশে পাঠানো অনেক সহজ, যদিও তা কিছুটা ব্যয়বহুল। বলা যায় যুগের চাহিদার তুলনায় ডাকবিভাগ দিনকে দিন সেকেলে আর পিছিয়ে পড়াদের দলে থিতু হয়ে যাচ্ছে।
একসময়ের অতি পরিচিত ব্যক্তি হিসেবে বেশ পরিচিত মুখ ছিলো ‘রানার’। আজ আর নেই তার সেই জৌলুশ আর জনপ্রিয়তা। ইন্টারনেট ই- মেইলসহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি মানুষের সামনে দ্রুত যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে দিলেও অফিসিয়াল বিভিন্ন ডকুমেন্টস আদান-প্রদান, সরকারি -বেসরকারি চাকরি সংক্রান্ত কাজে আজো ডাক বিভাগের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব বহন করে এই ডিজিটাল যুগেও। ডাকবিভাগ তার জৌলুস হারালেও তাকে কালের সাক্ষী আর অতীত ঐতিহ্য যাই বলি না কেন, সে তার ঐতিহ্যকে ধারণ করে আজো গণমানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। ডাক বিভাগের আধুনিকায়নে সরকার বেশ তৎপর। তারপরও এগুতে এগুতে বারবার পিছিয়ে আছে আমাদের ডাক বিভাগ।
বাংলাদেশ সরকার ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন ও পাবলিক সেবার কথা চিন্তা করে, সরকারি ডাকসেবা সময়োপযোগী করার লক্ষ্য নিয়ে ২০০০ সালে ই-পোস্ট সার্ভিস চালু করেছে, যাতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে । সার্ভিসটি দীর্ঘ দিন পরও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল সঙ্কট আর প্রচারণার কার্পণ্যের কারণে। বর্তমানে পোস্ট অফিসকে আধুনিকায়ন করতে ল্যাপটপ, ফটোকপি, স্ক্যানার, ক্যামেরা, মডেম/ ওয়াইফাইসহ ইন্টারনেট সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার সুফল ঢাকঢোল পিটিয়ে না হলেও তৃণমূল জনগণ ভোগ করছে তাদের প্রয়োজনে। সূত্রমতে, সারাদেশে ডাকঘর ৯ হাজার ৮৮৯টি, এর মধ্যে জেনারেল পোস্ট অফিস চারটি। জেলা শহরগুলো মিলিয়ে ৬৬টি। উপজেলা, গ্রামে রয়েছে ৮২০০টি এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ডাকঘর। অনেক জেলা শহরে রয়েছে নাইট পোস্ট অফিস। ডাক বিভাগের গুরুত্বকে অর্থবহ করতে আরো আধুনিকায়ন দরকার। তার সঙ্গে প্রয়োজন যোগ্য জনবল। ডাকবাক্সে চিঠি না ফেললেও এই ঐতিহ্যবহনকারী বাক্সগুলোকে জরাজীর্ণতা থেকে মুক্তি দিয়ে সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ের ডাকঘরগুলো জীর্নশীর্ন অবস্থায় অনেকটা অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ইউনিয়নের ডাকঘরগুলোর নেই নিজস্ব জায়গা। এগুলোকে সংস্কার করে, নিজস্ব ভবন নির্মাণ করে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।এজন্য গ্রামাঞ্চলের ডাকঘরগুলোর সংস্কার অতি জরুরি। অনেক এলাকায় পুরনো এই বিভাগের নিয়ন্ত্রিত ডাকঘরের অস্তিত্ব বিলীনের পথে, কারণ ডাকঘরগুলোর নেই নিজস্ব ভবন। সরকারের প্রতি সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবি ডাকঘরের বেদখলীয় ভূমি উদ্ধার করে নিজস্ব ভবন নির্মাণ করার। ইউনিয়নের পোস্টমাস্টারদের বেতনের বিষয়টিও ভেবে দেখার সময় এসেছে বলে মনে করেন সচেতন মহল। কুরিয়ার সার্ভিসের মতো আধুনিক পদ্ধতি এবং ডিজিটাল ব্যাবস্থাপনা করলে আশা করা যায় ডাক বিভাগের সুদিন ফিরবে। দেশের ডাকঘরগুলো সচল হোক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সেই শুভ প্রত্যাশায় বিশ্ব ডাক দিবসের উদ্দেশ্য সফল হোক, সার্থক হোক এই কামনা করছি।