অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে নির্যাতনকারী জেলা প্রশাসনের তৎকালীন রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিনকে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তাকে কিশোরগঞ্জের ইটনায় ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয়।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে তাকে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয়।
কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে সরকারি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফকে তার শোবার ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট ও আনসার সদস্যরা।
তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে আরিফকে পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তুলে জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে ধরলা নদীর তীরে ক্রসফায়ারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও পরে সেখান থেকে ফিরিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে আরিফের ঘরে আধা বোতল মদ ও দেড়শো’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এক বছরের কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড দিয়ে রাতেই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ উঠলে এক দিনের মাথায় জামিনে মুক্তি পান আরিফ। পরে তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পরে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় সুলতানা পারভীনকে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) স্থগিত, এনডিসি রাহাতুল ইসলামের তিনটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন, আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে নিচের ধাপে নামিয়ে দেওয়া এবং রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে অভিযুক্ত চারজনই রাষ্ট্রপতির কাছে দায়মুক্তি নেন।
এদিকে, ঘটনার পর নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আরিফ কুড়িগ্রাম সদর থানায় এজাহার দিলে হাইকোর্টের নির্দেশে ডিসি সুলতানা পারভীন ও আরডিসি নাজিমসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও নির্যাতনের অভিযোগ মামলা রেকর্ড হয়। গত ৪ বছরেও সেই মামলা আলোর মুখ দেখেনি। মামলাটি বর্তমানে রংপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে তদন্তাধীন। তবে গত চার বছরে মামলার কোনো আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেনি। বরং তাদের প্রত্যেককেই বিভিন্ন দায়িত্বে পোস্টিং দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পরে এসব পোস্টিংয়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু সে নোটিশের জবাব না পাওয়ায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আরিফ এ রিট দায়ের করেন।
আরিফের আইনজীবীরা তখন জানান, ওই চার জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলমান। সে মামলায় তারা এখনও জামিন নেননি। ফলে আইনের দৃষ্টিতে তারা এখনও পলাতক। তারা ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে বরখাস্ত না করে এক আসামিকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল যা আইন বহির্ভূত। সে কারণেই হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও পোস্টিং কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে একই মামলার অপর তিন আসামিকে পোস্টিং না দেওয়ার বিষয়ে বিরত থাকতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতেও রুল জারি করেন আদালত।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব রুল জারি করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ রুলের জবাব না দিয়ে আদালতকে উপেক্ষা করে চার আসামিকেই পোস্টিং দেয়া হয়। সেসময় নাজিম উদ্দিনকে সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়।
ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও ইউএনও হিসেবে পদায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, তাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও হিসেবে পদায়ন করার পর আজকে ইটনা আবার বদলি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার জানা ছিলো না এই সেই নিজাম উদ্দিন। তবে তাকে প্রত্যাহারের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক আদেশে তাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিলো।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম বলেন, আমাদের দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও আমরা সেটা মানিনা। বরং এক্ষেত্রে সাধারণত দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি প্রদান করা হয়। ফলে সরকারি মদদেই তারা দুর্নীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়েন।
নিজের পোস্টিংয়ের বিষয়ে নাজিম দাবি করেন, বিভাগীয় যে মামলা হয়েছিল তা ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে এ সংক্রান্তে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কিনা তা তার জানা নেই। তিনি জানান, তিনি এখন কিশোরগঞ্জের পথে আছেন।
নাজিমের পোস্টিংয়ের বিষয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম বলেন, আইন আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এভাবে একজন আসামিকে ইউএনওর মতো পদে পোস্টিং দেওয়া আইনের শাসনের পরিপন্থি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এমন দৃষ্টান্ত কাম্য নয়। নাজিম উদ্দিনের মতো ব্যক্তি সবসময় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করার দাবি জানাই।
এদিকে, মামলার তদন্ত কোন পর্যায়ে সে বিষয়ে রংপুর পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক রায়হানুল রাজ দুলাল জানান, সম্প্রতি তিনি মামলাটির দায়িত্বভার পেয়েছেন এবং তিনি মামলাটি এখন পর্যালোচনা করছেন। এর বেশি কিছু তিনি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।