অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সচিব, সিনিয়র সচিব, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, জনসংযোগ কর্মকর্তা ও অধিদফতরগুলোর প্রধান থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনেও ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। অর্ধশত জেলায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন জেলা প্রশাসক। আর এই নিয়োগ নিয়েই বেঁধেছে বিপত্তি। নতুন নিয়োগ বাতিল চেয়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভ শুরু করে বিগত আমলে পদোন্নতি বঞ্চিত একদল কর্মকর্তা। এমনকি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হৈচৈও করে তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আট জেলার ডিসি নিয়োগ বাতিল করা হয়। এমনকি বাকি নিয়োগও বাতিল হতে পারে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে মাঠ প্রশাসনে। এতে কমেছে কাজের গতি। আবার যেসব কাজ চলছে তাও ঢিলেঢালা। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। ডিসি নিয়োগ নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান দ্রুতই হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট গঠিত হয় অর্ন্তবর্তী সরকার। নতুন সরকার গঠন করার পর থেকেই আওয়ামী লীগের আমলে সময় নিয়োগ দেওয়া প্রশাসন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়। ওই প্রশাসন পরিবর্তনে নানা মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় ব্যাপক রদবদল। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের পরিবর্তন দিয়ে হয় শুরু, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। একদিনেই ১১ সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। আবার বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো অনেককে। পাশাপাশি দেওয়া হয় পদায়নও।
এমনকি গত ১৫ বছরে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাদের প্রতিকার দেওয়ার উদ্যোগ নিতে কমিশন গঠন করা হয়েছে। আবার পদোন্নতি-পদায়নের জন্য সচিবালয়ের ভেতরেই বিক্ষোভ করছেন কিছু কর্মকর্তা। বিসিএস বিভিন্ন ব্যাচ ও ক্যাডার এবং কর্মচারীরাও সরব রয়েছেন দাবি আদায়ে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ২৫০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে বিপত্তি বেঁধেছে মাঠ প্রশাসন নিয়ে।
নতুন ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিপাকে জনপ্রশাসন
অনেকটা ঘটা করেই গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দিনে ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নিয়োগের পর পরই অনেকে কাজে যোগ দিতে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। তবে বিপত্তি বাঁধে যারা এই পদায়ন থেকে যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের নিয়ে। তারা এই নিয়োগ বাতিলের দাবি তোলেন। এমনকি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি করেন তারা। উপ-সচিব পর্যায়ের ওই সকল কর্মকর্তা এক সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ শাখার যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের কক্ষে ঢুকে হৈচৈ করেন।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন নিয়োগ দেওয়া আট জেলার জেলা প্রশাসক নিয়োগ বাতিল করা হয়। এ ছাড়া চার জেলার জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তন করা হয়। বাকি নিয়োগ প্রাপ্তদের নিয়োগ যাচাই-বাছাই করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদকে প্রধান করে গঠন করা ওই কমিটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে বাকি জেলাগুলোর ডিসিদের নিয়োগ বাতিল হবে কি না। যদিও এখন পর্যন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানা গেছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কমিটি নিয়োগগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে। কর্মকর্তাদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে নিয়োগ বাতিল হতে পারে।
কমেছে কাজের গতি
প্রশাসনে রদবদলের কারণে কাজে ধীরগতি নেমে এসেছে। অনেক কর্মকর্তাই স্বীকার করেছেন যে, একদিনে হঠাৎ করেই পদায়ন-পদোন্নতি হওয়ায় কাজ বুঝে নিতেও সময় লাগছে। আবার গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া প্রশাসনের কর্মকর্তা যারা এখনো নিজ পদে বহাল আছেন, তারাও শঙ্কায় রয়েছেন নিজের অবস্থান নিয়ে। কারণ, সরকারের উচ্চ পর্যায় এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেও শেখ হাসিনা সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রশাসন ভেঙে দেওয়ার দাবি রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, নতুন নির্দেশনা বাস্তবায়নে তারা দো-টানায় রয়েছেন। সরকার তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে কি না সেটা বুঝতে পারছেন না। যে কারণে এই সময়ে কাজের গতি বেশ কমেছে। বিশেষ করে বেশ প্রভাব পড়েছে মাঠ প্রশাসনে। এদিকে, প্রশাসনের সব পর্যায়ে সংস্কার করে কাজের গতি বাড়াতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন।
অস্থির সচিবালয়
অর্ন্তবর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ব্যাপক রদবদল শুরু হয় প্রশাসনে। আর এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে সচিবালয়ে। যোগ্যতা থাক আর না থাক, মনের মতো পদ না পাওয়া নিয়ে সচিব থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত সবাই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বৈষম্যের শিকার বলে দাবি তুলেছেন। তাদের দাবির মুখে অনেক কর্মকর্তা পদ ছেড়ে দিয়েছেন। যারা আছেন এখন তারাও ভয়ে রয়েছেন।
যা বলছেন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা
জেলা প্রশাসক নিয়ে বিপত্তি দেখা দেওয়ার পর থেকেই অনেকটা গা ঢাকা পরিস্থিতিতে রয়েছেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিসি নিয়োগ বাতিল চেয়ে উপ-সচিব পদের কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ হৈচৈ’র পর থেকে নিয়মিত অফিস করছেন না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান ও তার অধীনস্ত নিয়োগ, পদোন্নতি এবং প্রেষণ বিভাগের কর্মকর্তারা। যারা অফিস করছেন তারাও এড়িয়ে চলছেন অতিথিদের। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে একেবারেই দেখার অনুমতি দিচ্ছেন না। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) এপিডি বিভাগের এক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে তিন ঘণ্টা বসে থাকলেও গণমাধ্যমকর্মীদের সুযোগ দেননি তিনি। এদিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অফিস করছেন না মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনও। এদিকে, পদবঞ্চিতরা প্রতিদিনই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চক্কর দিচ্ছেন। তাদের একজন মহিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওই দিনের (১০ সেপ্টেম্বর) পর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাচ্ছি না। আমাদের সঙ্গে প্রশাসন অন্যায় করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যে সকল কর্মকর্তা সুবিধা পেয়েছেন তাদের আজও পদোন্নতি, পদায়ন হচ্ছে।’
এর আগে, গত সপ্তাহে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেছিলেন, ‘যেহেতু নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাই আমরা এরই মধ্যে ৮ জেলার নিয়োগ বাতিল করে দিয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়ে কমিটি যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেবে।’
এদিকে, গত মঙ্গলবার এক বৈঠকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিষয়টি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, যোগ্য ও সৎ অফিসার খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৎ কর্মকর্তার অভাবে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, যে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তবে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। ডিসি নিয়োগ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান আশা করেন তারা।